অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর ফাঁদে তরুণ প্রজন্ম

অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর ফাঁদে তরুণ প্রজন্ম: এক নীরব বিপর্যয়ের চিত্র

স্মার্টফোন আজকের তরুণ সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন ও তথ্যপ্রাপ্তির অসীম পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ এক দিকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে—অনলাইন জুয়ার আসক্তি।

অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর ফাঁদে তরুণ প্রজন্ম

পড়াশোনা, সৃজনশীলতা বা পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির বদলে বহু তরুণ আজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে যাচ্ছে অনলাইন বেটিং, ক্যাসিনো-অ্যাপ ও গেম্বলিংয়ের অদৃশ্য নেশায়। কোভিড-পরবর্তী সময়ে বেকারত্ব ও সময়ের অপচয় এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘একটু চেষ্টা করি’, ‘শুধু ১০০ টাকা দিয়ে শুরু’—এই নিরীহ ভাবনা থেকেই শুরু হওয়া এই খেলা সময়ের সঙ্গে রূপ নিচ্ছে ভয়ংকর আসক্তিতে।

তারুণ্যের লুকানো ট্র্যাজেডি: রুবেলের গল্প

লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের কলেজছাত্র রুবেলের গল্প এখন শত শত তরুণের সাধারণ বাস্তবতা।

মহামারির সময় ঘরে বসে ইউটিউবে দেখেছিল ‘স্পিন ঘুরিয়ে ৫০০ টাকা আয় করুন’—এমন প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন। প্রথমে কৌতূহল থেকে শুরু হলেও ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে অনলাইন জুয়ার নেশাগ্রস্ত।

কয়েকবার জেতার পর ভুল ধারণা জন্মায়—এই খেলাতেই নাকি তার ভাগ্য বদলে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সে শুধু হারতেই থাকে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রুবেল নেয় অনলাইন লোন, বন্ধুদের থেকে ধার, এমনকি বিক্রি করে দেয় মায়ের সোনার চেইন। শেষ পর্যন্ত ঋণের চাপে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, কলেজ ছাড়ে, আর তার পরিবার আজও সেই ঋণের বোঝা বইছে

রুবেলের গল্প কোনো ব্যতিক্রম নয়—দেশের প্রতিটি জেলা, প্রতিটি মহল্লায় এমন শত শত তরুণ আজ এই অদৃশ্য ভার্চুয়াল ফাঁদে আটকা পড়ে জীবন নষ্ট করছে।

পরিসংখ্যানে ভয়াবহ বাস্তবতা

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিস্তার আশঙ্কাজনক মাত্রায় পৌঁছেছে।

  • গত দুই বছরে অনলাইন জুয়া, বেটিং এবং অ্যাপভিত্তিক প্রতারণার অভিযোগ বেড়েছে প্রায় ৬০%।
  • দেশের ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬৫% তরুণ, যাদের একটি বড় অংশ নিয়মিত বিদেশি বেটিং সাইট ব্যবহার করছে।
  • ২০২৩ সালে ৬০০+ জুয়ার সাইট বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিদিনই নতুন সাইট তৈরি হচ্ছে।
  • বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতি মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশি জুয়া প্ল্যাটফর্মে পাঠানো হচ্ছে।
  • ২০২৪ সালে জরিপ বলছে, প্রতি ১০ জন তরুণের মধ্যে ৩ জন অন্তত একবার অনলাইন জুয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরে তরুণ জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা ১৫–২০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

বিশ্বব্যাপী বাজার ও বাংলাদেশের ঝুঁকি

বিশ্বব্যাপী অনলাইন জুয়ার বাজার এখন ৯০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ কঠোর আইন করে এই জাল ছেঁটে ফেললেও বাংলাদেশে এখনো সুস্পষ্ট আইন নেই। ফলে তরুণরা সহজেই বিদেশি অ্যাপ, ওয়েবসাইট ও টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোর ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে।

অনলাইন জুয়ার আসক্তি: অদৃশ্য কিন্তু ভয়ংকর

অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এটি অদৃশ্য নেশা।
  • এটি মাদকাসক্তির মতোই মস্তিষ্কের আচরণ পরিবর্তন করে।
  • শুরুতে মনে হয় নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু হারার পর হারানো টাকা ফেরত আনার তাড়নায় আসক্তি আরও বাড়ে।
  • পারিবারিক ঝগড়া, পড়াশোনার অবনতি, চাকরি হারানো, ঋণগ্রস্ততা—সবই দেখা যাচ্ছে এই নেশার প্রভাবে।
  • চরম পর্যায়ে গিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

অর্থনীতি ও সমাজে অপরাধের বিস্তার

অনেক তরুণ টাকা হারানোর পর—

  • পরিবার থেকে চুরি করছে,
  • বন্ধুর কাছে ধার নিচ্ছে,
  • উচ্চসুদের লোন-অ্যাপ থেকে ঋণ নিচ্ছে,
  • প্রতারণা বা অনলাইন ফ্রডে জড়িয়ে পড়ছে।

এটি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়—বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে, যার প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে।

ভার্চুয়াল দুনিয়ার দুর্বল নিয়ন্ত্রণ

বেশিরভাগ জুয়ার অ্যাপ বিদেশ থেকে পরিচালিত হওয়ায় বন্ধ করা কঠিন।

বিটিআরসি হাজারো সাইট ব্লক করলেও প্রতিদিনই নতুন ডোমেইন খোলা হচ্ছে। অনেক গেমের মধ্যেও ‘কয়েন কেনা’, ‘স্পিন আনলক’ ইত্যাদি ফিচারের মাধ্যমে তরুণরা অজান্তেই জুয়ার লেনদেনে জড়িয়ে পড়ছে।

মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব

  • অনলাইন জুয়া কেবল আর্থিক সমস্যা নয়—এটি মানসিক রোগ।
  • পরিবারের উচিত তিরস্কারের বদলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা।
  • রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুনর্বাসন ও সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সেলিং সেন্টার জরুরি।
  • সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই নেশা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।

মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন, ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রচার তরুণদের জুয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।রাষ্ট্রের উচিত এই বিজ্ঞাপনগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা। সেলিব্রিটি ও কনটেন্ট ক্রিয়েটরদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে হবে।

পরিবার, স্কুল ও সমাজের ভূমিকা

  • অভিভাবকরা সন্তানদের মোবাইল ব্যবহারে নজরদারি করতে পারেন।
  • স্কুল–কলেজে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও অনলাইন জুয়ার ক্ষতি বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস প্রয়োজন।
  • ফ্রিল্যান্সিং, কোডিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, গেম ডেভেলপমেন্টের মতো দক্ষতার চর্চা বাড়াতে হবে। তরুণ বিকল্প অনুপ্রেরণা পেলে সহজেই ‘সহজ টাকার’ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসবে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি

এই সংকট এখন আর ব্যক্তিগত সমস্যা নয়—জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতির জন্য হুমকি।

কিছু জরুরি পদক্ষেপ—

  1. সাইবার পুলিশ ইউনিটকে শক্তিশালী করে জুয়া প্ল্যাটফর্ম শনাক্ত ও বন্ধ করা।
  2. মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল পেমেন্টে সন্দেহজনক লেনদেন মনিটরিং কঠোর করা।
  3. অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে স্পষ্ট আইন প্রণয়ন।
  4. তরুণদের জন্য নিরাপদ ডিজিটাল বিনোদন, ই-লার্নিং ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

শেষকথা

স্মার্টফোন জ্ঞান, দক্ষতা ও উন্নতির দরজা—ধ্বংসের নয়।

তরুণরাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ; তাই তাদেরকে অনলাইন জুয়ার মতো অন্ধকার পথ থেকে ফিরিয়ে আনা এখনই জরুরি। সচেতন সমাজ, শক্তিশালী আইন, এবং পরিবার–শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টাই পারে এই বিপর্যয় থামাতে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url